Pages

Tuesday, December 10, 2013

টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ চমচম

টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ চমচম



মো. রেজাউল করিম::টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম। যার নাম শুনলেই জিভে পানি আসে। অতুলনীয় স্বাদ আর সুগন্ধের কারণে দেশে ব্যাপক সুনাম রয়েছে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের। পোড়া ইটের মতো রঙের এই বিখ্যাত সুস্বাদু চমচমের কড়া মিষ্টির আবরণের ভিতরে রয়েছে গোলাপী আভাযুক্ত নরম অংশ। মিষ্টি জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ঐতিহ্যবাহী এই চমচম বৃটিশ আমল থেকে অবিভক্ত ভারতবর্ষসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টাঙ্গাইলকে ব্যাপকভাবে পরিচিতি করেছে। অনেকের মতে, গৌড় নামের এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম পোড়াবাড়িতে এই সুস্বাদু চমচম তৈরি ব্যবসা শুরু করেন।

চমচম ব্যবসায়ী রণজি ঘোষ জানান, পোড়াবাড়ির চমচমের সৃষ্টি রহস্য। টাঙ্গাইল জেলা শহর থেকে প্রায় কিলোমিটার পশ্চিমে এই পোড়াবাড়িতে এক সময় লঞ্চঘাট ছিল। বৃটিশ আমলে ধলেশ্বরী নদীর ঢালান ঘাটে ভিড়ত স্টিমার আর মালবাহী জাহাজ। ওই সময় দেশ বিদেশের মানুষ নামত পোড়াবাড়িতে। দেশ বিদেশের মানুষের আগমনে পোড়াবাড়ি ছিল জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র। তখন আসাম থেকে আগত দশরথ গৌড় ধলেশ্বরীর সুস্বাদু পানি এখানকার গাঢ় দুধ দিয়ে চমচম নামের এই মিষ্টি প্রথম তৈরি করেন। চমচমের স্বাদ মূলত পানির ওপর নির্ভরশীল। পোড়াবাড়ি পানির মধ্যে মিষ্টি তৈরির মূল রহস্যনিহিত।
বাংলাদেশের অনেক জায়গায় টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি থেকে কারিগর নিয়ে চমচম তৈরির চেষ্টা করেও কেউ সফল হতে পারেননি। অপূর্ব স্বাদের ফলে এ চমচম সারা ভারতবর্ষে সুখ্যাতি লাভ করে। পূর্বে লঞ্চ, স্টিমার করে পোড়াবাড়ির চমচম ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে যেত। প্রতিদিন ২শ’ থেকে ৩শ’ মণ চমচম তৈরি করা হতো পোড়াবাড়ির বিভিন্ন চমচম কারখানায়। যমুনার কোলে প্রবল স্রোতস্বিনী ধলেশ্বরী নদীর সুস্বাদু পানি, গাভীর ঘন দুধ ও কারিগরদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় পোড়াবাড়ির চমচম ‘মিষ্টির রাজা’ হিসেবে সুনাম অর্জন করে। ব্যাপক সাফল্যের কারণে তখন পোড়াবাড়িতে ৩৫-৪০টি চমচম তৈরির দোকান গড়ে ওঠে। চমচম তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয় প্রায় ২ শতাধিক পরিবার। চমচমের স্রষ্টা দশরথ গৌড়ের সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে রাজারাম গৌড়, নারায়ণ হালুই, মোদন গৌড়, শিব শংকর ও কুশাই দেবের নাম উল্লেখযোগ্য।
টাঙ্গাইলের একজন প্রবীণ চমচম ব্যবসায়ী সম্ভু ঘোষ জানান, ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই পোড়াবাড়িতে প্রথম চমচম তৈরি শুরু হয়। এ সময় দুধ ছিল খুবই সস্তা। দুধের কোনো মাপ ছিল না। এক ঘটি দুধের দাম ছিল তিন পয়সা থেকে পাঁচ পয়সা। প্রতি সের চমচম বিক্রি হতো সাত আনা থেকে আট আনায়। চল্লিশের দশকে চমচম বিক্রি হতো ১টাকা সের। বর্তমানে ১৪০ থেকে ২৫০ টাকায় এক কেজি মিষ্টি বিক্রি করে লাভ হয় ১০ টাকা থেকে ১২ টাকা। আর তখন এক সের চমচম ৫ সিকিতে বিক্রি করে আট আনা লাভ হতো। বহু দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা পোড়াবাড়ির চমচমের ভক্ত ছিলেন। এর মধ্যে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, জাদু সম্রাট পিসি সরকার, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম উল্লেখযোগ্য। জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, নবাব আলী চৌধুরী, প্রিন্সিপাল ইব্রহিম খাঁ, প্রমথ নাথ চৌধুরীসহ অনেক ব্যক্তিত্বের পদচারণায় পোড়াবাড়ি ধন্য হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পোড়াবাড়ি মদন লালের মিষ্টি ঘরে বসতেন। চমচম নিয়ে আপ্যায়ন করতেন রাজনৈতিক শিষ্য ও ভক্তদের। ত্রিশ দশকের শেষের দিকে আসামের রামেন্দ্র ঠাকুর, তীর্থবাসী ঠাকুর টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারে মিষ্টি তৈরিসহ ব্যবসা শুরু  করেন। এরপর থেকে পাঁচআনী বাজার মিষ্টিপট্রি নামে পরিচিতি হয়ে আছে।
১৯৬০ সালের পর টাঙ্গাইল মহকুমার টাঙ্গাইল সদরে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। এ সময় ধলেশ্বরীর বুকে জেগে উঠে অসংখ্য চর। যে ধলেশ্বরী তার বুকের যৌবন সুধা ফেলে দিয়েছিল চমচমের ওপর, পরবর্তীতে গুটিয়ে নেয় তার ব্যাপ্তি। বন্ধ হয়ে যায় পোড়াবাড়ির লঞ্চ ও স্টিমার ঘাট। জনবহুল পোড়াবাড়ি এক সময় জনশূন্যে হয়ে যায়। কারিগর-শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ে। তারা পরে অন্য পেশায় চলে যায়।
বর্তমানে পোড়াবাড়ির অবস্থা করুন। নানা সমস্যায় জর্জরিত ছোট একটি বাজারে মাত্র ৪/৫টি জড়াজীর্ণ মিষ্টির দোকান ঐতিহ্যকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে বাজারের আশপাশের ৬/৭টি বাড়িতে এখনো মিষ্টি তৈরি হয় এবং তারা ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোর, বগুড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করছে। এছাড়াও শহরের পাঁচআনী বাজারে কয়েকজন মিষ্টি ব্যবসায়ী ঢাকার শতাধিক দোকানসহ প্রায় দেশের ৫ শতাধিক মিষ্টি ব্যবসায়ীদের এই মিষ্টি সরবরাহ করে থাকে। অপরদিকে কিছু কিছু অসাধু মিষ্টি ব্যবসায়ী টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের নাম করে বড় বড় সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে ঢাকাসহ কয়েকটি জায়গায় মিষ্টির দোকান গড়ে তুলেছে। এসব দোকান থেকে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে আসল নকল চমচম চেনা বড় দায় হয়ে পড়েছে। পোড়াবাড়ির আসল চমচমের কারিগররা অর্থের অভাবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। অন্যদিকে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে পোড়াবাড়ির নাম ভাঙিয়ে ভেজাল চমচম বিক্রি করে অনেকেই বাড়ি গাড়ির মালিক হয়েছেন।  এতে পোড়াবাড়ির চমচম ঐতিহ্যবাহী গৌরব হারিয়ে ফেলছে। প্রকৃত কারিগর ও ব্যবসায়ীরা আর্থিক লাভ থেকে বঞ্চিত হয়ে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তদের অভিমত, এ গৌরবময় ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারিভাবে কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতা করার পাশাপাশি ভেজাল চমচম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। ভেজাল আর নকলের ভিড়ে হয়ত আসল চমচম আর ভেসে উঠবে না। তাহলে হারিয়ে যাবে ঐতিহ্য আর গৌরব?

No comments:

Post a Comment